🚲 ঢাকায় রিকশার প্রথম আগমন ও ইতিহাস ||
ঢাকার পথঘাট, যানজট কিংবা সংস্কৃতি—রিকশা ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ! কিন্তু জানেন কি, ঢাকায় প্রথম রিকশা কবে এলো, কোথা থেকে এলো, আর একে প্রাচীন কালে কি নামে ডাকা হতো? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
🔹 রিকশার আবিষ্কার
রিকশার উৎপত্তি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে জাপানে। তখন এক জাপানি মানুষ ইজুমি ইয়োসুকে (Izumi Yosuke) একধরনের ছোট গাড়ি তৈরি করেছিলেন, যা মানুষ টেনে নিয়ে যেত। এ গাড়িকে বলা হতো রিকশা (শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষার Jinrikisha থেকে—“Jin” মানে মানুষ, “Riki” মানে শক্তি আর “Sha” মানে গাড়ি)।
অর্থাৎ, রিকশার আদি অর্থ হলো—“মানুষের শক্তিচালিত গাড়ি।”
—————————————
রিকশার উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি জনপ্রিয় গল্প হলো—একজন অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে রিকশার আবিষ্কার। তবে ইতিহাসে এটি পুরোপুরি সত্যি হিসেবে স্বীকৃত নয়, বরং লোককথা বা কিংবদন্তির মতো বেশি প্রচলিত। আমি আপনাকে বিস্তারিত বলছি:
—
রিকশার উৎপত্তি
রিকশার জন্মস্থান: রিকশার আবিষ্কার হয়েছিল ১৮৬০–৭০ এর দশকে জাপানের টোকিওতে।
প্রথম নির্মাতা: ইতিহাসে তিনজন আবিষ্কারকের নাম পাওয়া যায়— ইজুমি ইয়োসুকে, তাকায়ামা কসুজো এবং সুজুকি তোড়াজো। তারা ১৮৬৯ সালের দিকে রিকশার প্রথম নকশা তৈরি করেন।
রিকশা (Rickshaw) শব্দটি এসেছে জাপানি শব্দ “Jin-riki-sha” (人力車) থেকে, যার মানে হলো মানুষের শক্তিচালিত গাড়ি।
———————————-
স্ত্রীকে হাসপাতালে নেয়ার গল্প
কিছু বই ও জনপ্রিয় লেখায় বলা হয়, তাকায়ামা কসুজো নামের একজন মিশনারি বা ব্যবসায়ী তার অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য এই বাহন তৈরি করেছিলেন। ঘোড়ার গাড়ি ছিল দামি, আর হাঁটিয়ে নেওয়া কঠিন—তাই তিনি কাঠ ও লোহার তৈরি হালকা দুই-চাকার গাড়ি বানান, যেটা একজন মানুষ টেনে নিতে পারে।
এই গল্পটা অনেক বই ও প্রবন্ধে পাওয়া যায়, কিন্তু জাপানি সরকারি আর্কাইভে এর সরাসরি প্রমাণ নেই। বরং তিনজন আবিষ্কারকের যৌথ উদ্যোগেই রিকশার প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তাই স্ত্রীকে বাঁচাতে রিকশার আবিষ্কার—এটা সুন্দর একটি কিংবদন্তি, কিন্তু নিশ্চিত ঐতিহাসিক সত্য নয়।
দ্রুত জনপ্রিয়তা
১৮৭০-এর দশকে জাপান জুড়ে হাজার হাজার রিকশা ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর চীন, ভারত, বার্মা (মায়ানমার) হয়ে ২০শ শতকের শুরুতে ঢাকা সহ উপমহাদেশে আসে।
ঢাকায় প্রথম রিকশা আসে ১৯৩৮ সালে ||
________________
🔹 রিকশার আগমন উপমহাদেশে
জাপান থেকে এই পরিবহনটি প্রথমে চীন, তারপর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কলকাতায় পৌঁছায়। কলকাতায় রিকশা আসে উনিশ শতকের শেষভাগে (১৮৮০–১৮৯০ সালের দিকে)।
🔹 ঢাকায় প্রথম রিকশা
ঢাকায় প্রথম রিকশা আসে ১৯৩৮ সালে।
সে সময় কলকাতায় চাকর করা কিছু ধনী পরিবারের লোকেরা রিকশা দেখে মুগ্ধ হন এবং ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় প্রথমে মাত্র তিনটি রিকশা চলে।
🔹 কার হাত ধরে এলো রিকশা?
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ঢাকার নবাব পরিবারের এক আত্মীয় কলকাতা থেকে রিকশা নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে এটি জনপ্রিয় হতে থাকে।
প্রথম দিকে রিকশা ছিল শুধু অভিজাত পরিবার ও ধনীদের যাতায়াতের বাহন। পরে ক্রমে এটি সাধারণ মানুষের পরিবহন হয়ে ওঠে।
————-
সংক্ষেপে—সবচেয়ে স্বীকৃত তথ্য বলছে: ১৯৩৮ সালে নরায়ণগঞ্জ ও নেত্রকোনায় থাকা ইউরোপীয় জুট–ব্যবসায়ীদের হাত ধরে কলকাতা থেকে সাইকেল রিকশা আসে; সেখান থেকেই ঢাকায় রিকশার সূচনা।
আরও কিছু বর্ণনা আছে—
কেউ কেউ বলেন সূত্ৰাপুরের এক বাঙালি জমিদার ও ওয়ারীর এক মারোয়ারি ব্যবসায়ী ১৯৩৮ সালে ছয়টি রিকশা আনেন ও চালু করেন।
একজন গবেষকের মতে র্যালি ব্রাদার্স জুট কোম্পানির এক ক্লার্ক ১৯৪০ সালে নরায়ণগঞ্জে একটি রিকশা আনেন; প্রথম মালিক ছিলেন জদু গোপাল দত্ত, প্রথম চালক নরেশ—এই গল্পটাও প্রচলিত।
তাই “কার হাত ধরে” প্রশ্নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উত্তর হলো: ইউরোপীয় জুট রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে—যদিও লোকশ্রুতিতে উপরকার মতো কয়েকটি বিকল্প বিবরণও পাওয়া যায়।
————-
বাংলাদেশের প্রথম রিকশা কোথায় এলো ও কখন?
১. চট্টগ্রাম — ১৯১৯ সালে
হাতে টানা রিকশা (hand-pulled) প্রথম ১৯১৯ সালে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে, এবং এটি ছিল মিয়ানমার (তৎকালীন রেঙ্গুন) থেকে আনা।
______________________
ঢাকায় প্রথম রিকশা লাইসেন্স কখন দেওয়া হয়?
প্রথম রিকশা লাইসেন্স ঢাকায় প্রদান করা হয় ১৯৪৪ সালে। এ তথ্য বিশ্বকোষ ও ইতিহাসগত উৎস থেকে পাওয়া যায় ।
এই লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া চালু করার পর থেকেই ঢাকায় রিকশা চলাচল—বা অফিসিয়ালি চালু থাকা—আইনগতভাবে স্বীকৃত হতো।
অতিরিক্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য:
রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স বন্ধ করা হয় ১৯৮৬/৮৭ সালে। ঢাকায় ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭৯,৫৫৪টি রিকশা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ।
পরে এই লাইসেন্স প্রদান কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে অনেক রিকশা আজও অফিসিয়াল বা অনিয়মিত লাইসেন্স ব্যবহার করে চলছে ।
সারসংক্ষেপ টেবিল:
বিষয় বিবরণ
প্রথম রিকশা লাইসেন্স ঢাকায় ১৯৪৪ সাল
সর্বমোট লাইসেন্স (১৯৮৬ পর্যন্ত) ৭৯,৫৫৪টি
লাইসেন্স প্রদান বন্ধ ১৯৮৬/৮৭ সাল
পরবর্তী আইনগত বা আনলাইসেন্স অনেক রিকশা আইনের বাইরে বা অনিয়মিতভাবে চলছে
🔹 প্রাচীন কালে রিকশার নাম
প্রথম দিকে ঢাকায় রিকশাকে অনেকে ডাকত “মানুষ টানা গাড়ি” নামে। তবে জাপানি শব্দ “রিকশা” থেকেই বর্তমান নামটি প্রচলিত হয়।
🔹 আজকের রিকশা
ঢাকায় এখন প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ রিকশা আছে বলে ধারণা করা হয় (যদিও লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংখ্যা অনেক কম)। রঙিন, অলঙ্কৃত, বর্ণিল এই রিকশা এখন শুধু পরিবহন নয়—বরং ঢাকার সংস্কৃতির অংশ
✅ সংক্ষেপে:
🚲 ঢাকায় রিকশার ইতিহাস (সংক্ষেপে একবারে)
আবিষ্কার → জাপান, ১৮৬৯ সালে (Jinrikisha = মানুষের শক্তিচালিত গাড়ি)।
বাংলাদেশে প্রথম → নারায়ণগঞ্জে, ১৯৩৮ সালে।
ঢাকায় প্রথম রিকশা → ১৯৩৮ সালেই কলকাতা থেকে আনা হয়, প্রথমে মাত্র ৩টি।
কারা এনেছিল → ইউরোপীয় জুট কোম্পানির কর্মকর্তারা / নবাব পরিবারের আত্মীয়রা কলকাতা থেকে আনেন।
প্রথম লাইসেন্স → ঢাকায় রিকশার প্রথম সরকারি লাইসেন্স দেওয়া হয় ১৯৪৪ সালে।
সর্বমোট লাইসেন্স → ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ৭৯,৫৫৪টি রিকশা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
লাইসেন্স বন্ধ → ১৯৮৬–৮৭ সালে।
প্রাচীন নাম → মানুষ টানা গাড়ি (Hand-pulled Rickshaw)।
👉 রিকশা শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং ঢাকার পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক।